গল্পকার শ্রদ্ধেয় ডা. মনসুর আলী ও তার চলে যাওয়া

সাহিত্য একাডেমির পরিচালক জনাব মোশাররফ হোসেনের স্ট্যাটাস থেকে প্রিয় গল্পকার অতি ভদ্র ও সুশীল সজ্জন শ্রদ্ধেয় ডা. মনসুর আলীর মৃত্যুসংবাদটি পড়ে স্তম্ভিত, মর্মাহত ও বেদনাগ্রস্ত হয়েছি। মনসুর ভাইয়ের সঙ্গে আমার একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে প্রায় ২৫ বছর পূর্ব থেকে। তাঁর সঙ্গে অনেক রকম স্মৃতির মধ্যে সাহিত্যস্মৃতিই বেশি প্রণিধানযোগ্য।

তাঁর মৃত্যুর পর সাহিত্য একাডেমির মাসিক অনুষ্ঠানে তাঁকে স্মরণ করা হয়েছে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়েছে। নিজস্ব বিবেকের দায়বোধ থেকে বিভিন্নজনের মানসিকতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে স্মৃতিচারণামূলক কথা বলার চেষ্টা করেছি। মনে হচ্ছিল মনসুর ভাই আমার পাশে বসা। গাড়িতে কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে।

আমি তখন ম্যানহাটনে থাকতাম। নিজের কর্মদিবসের পর বাসায় না গিয়ে শিল্প-সাহিত্যের অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। সাধারণত সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলো মিস হতো না। মনসুর ভাইয়ের বাসা কুইন্সের পারসন্স ব্লুবার্ডের কাছে। এখানে কবি শহীদ কাদরী প্রান্তিক জীবনে তাঁর স্ত্রী নীরা কাদরীর অ্যাপার্টমেন্টে একসঙ্গে বসবাস করতেন।

শহীদ ভাই ও নীরা ভাবী পরিচালিত ‘একটি কবিতা সন্ধ্যা’ অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর থেকে আমি নিয়মিত যোগ দিতাম। মনসুর ভাইও সেই অনুষ্ঠানে আসতেন। সেখানে মাঝেমধ্যে আমারও ছোটখাটো পারফরম্যান্স থাকত। কিন্তু মনসুর ভাই চুপচাপ বসে থাকতেন। তিনি নীরবে সবার কথা ও পারফরম্যান্স উপভোগ করতেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর চলে যেতেন।
ঘরে ফেরার সময় তাঁকে প্রায়ই নামিয়ে দিয়ে আমি আমার বাসায় চলে যেতাম। কখনো কবিবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত ভাইয়ের গাড়িতে জ্যাকসন হাইটস সাহিত্য একাডেমির মাসিক আসরে আসতেন। কখনো লিয়াকত ভাই আগে চলে গেলে আমি (উল্টো পথে) তাঁকে বাসায় নামিয়ে তারপর ম্যানহাটনে নিজের বাসার দিকে চলে যেতাম।

তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত, সম্ভবত বছর দুয়েক, লাঠি ভর করে হাঁটতে পারতেন। একপর্যায়ে লাঠিসহযোগে হাঁটাও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর প্রায় পাঁচ বছর বিছানায় অচল ছিলেন। হাঁটতে না পারলেও কিন্তু কখনো তাঁকে দুঃখবোধ ও অনুতাপে বিমর্ষ হতে দেখা যায়নি। কথা বলতেন সুস্থ-সবল ও সুখী মানুষের মতো। কেমন আছেন, জানতে চাইলেই বলতেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।’ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর স্মরণশক্তি অটুট ছিল। নির্ভুলভাবে সবকিছু বলতে পারতেন। কাউকেই তিনি ভুলে যাননি। যখনই কথা হতো, খুটে খুটে সবার খবর জানতে চাইতেন। শেষের দিকে শুয়ে শুয়ে ফোন ওঠাতে কষ্ট হতো। তবু অনেক কথা বলতে চাইতেন। আগে অবশ্য খুব কম কথা বলতেন। সাহিত্য আসরের খোঁজখবর জানতে চাইতেন। পত্র-পত্রিকার পাতা থেকে আমার লেখাগুলো পড়তেন এবং তাঁর মতামত জানাতেন।

অথচ আমরা অনেকেই কেমন যেন বিস্মরণের জাঁতাকলে চেতনে-অবচেতনে অনেক কিছুর কথা ভুলে যাচ্ছি। ক্রমাগত শারীরিক অক্ষমতা কিংবা বৈকল্যের চেয়েও কেন যেন আমরা মানসিক হীনম্মন্যতা ও বৈকল্যের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের আশপাশের প্রিয়জনদের কথা ভুলে যেতে বসছি। সমাজটা কেমন যেন একটা ফেইক/কৃত্রিমতার আদলে সবকিছু সাজিয়ে ফেলা হচ্ছে। পরিচিত মানুষের মাঝেও ক্রমাগত একটা দেয়াল তৈরি হয়ে যাচ্ছে! ফলে অনেকেই নিজেদের চেনা মানুষগুলোকে এড়িয়ে চলেন। এখন আর চিনতেও চান না।

শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে সামগ্রিক ক্ষেত্রেই আমাদের মানবিক ও সুশীল সমাজ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। একে অপরের প্রতি দায়বোধ, প্রেম ও ভালোবাসা কমে যাচ্ছে। আর সেই সুযোগে আমাদের মনন ও মানসকে বৈকল্যের নিদারুণ পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে!

ডা. মনসুর আলী ষাটের দশকের শেষ দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করা চিকিৎসক। পেশাগত জীবনে দেশে-বিদেশে কর্মরত ছিলেন। তিনি লিবিয়ায় চাকরি করার সময় প্রায় ৪৫ বছর আগে পবিত্র হজব্রত পালন করেছেন। তাঁর স্ত্রী শিরিন আখতারও একজন ডাক্তার। তিনিও বয়সের ভারে ন্যুব্জ এবং তাঁরও শারীরিক অবস্থা ভালো নেই। দুজনই বিনয়ী, চমৎকার মানুষ। দুজনই খুব ধর্মপরায়ণ। শুনেছি, তাঁর স্ত্রী প্রায়ই পবিত্র মক্কা-মদিনা জিয়ারত ও ওমরাহ পালন করতে যেতেন।

মনসুর ভাইয়ের নম্রতা ও বিনয়াবনত স্বভাব সবাইকে মুগ্ধ করত। পৃথিবীর নিয়ম অনুপাতেই শেষতক মনসুর ভাইও চিরকালের জন্য এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। অবিশ্বাস্য। কটা দিন ধরে মনটা ভালো যাচ্ছে না। কী রকম একটা স্মৃতির তাড়নার অনুরণন হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছে।

আমার জীবনে প্রাণপ্রিয় মা-বাবাসহ কত স্বর্গত আপনজনের স্মৃতির মধ্যে অহর্নিশ ডুবে আছি। তাঁদের সঙ্গে আরেকজনের সংযোজন ঘটল। তিনি হলেন গল্পকার ডা. মনসুর আলী। এখন তিনিও আমার স্মৃতিকোঠরে। তাঁর মৃত্যুর স্বাভাবিকতাটিও যেন অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত। যদিও মৃত্যুই স্বাভাবিক। ‘প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’

কোনো কোনো স্মৃতি এমনভাবে আমাদের জীবনের অনুসঙ্গী হয়ে যায়। সেসব স্মৃতি আমাদের প্রেম, ভালোবাসা, বিরহকাতরতা, শোক-সন্তাপ ও আমাদের সুখীনন্দ এবং দুঃখযাপনের সঙ্গী হয়ে থাকে। আমরা চাইলেও তা থেকে মুক্ত থাকতে পারি না।
মাঝে মাঝে ডা. মনসুর আলীর সঙ্গে কথা হলে এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়গুলো ছোবল মারতে চাইত। আমি বরাবরই নিয়ম মেনে চলার মানুষ। আমি আমার প্রাণপ্রিয় বাবার নিকট থেকে শিখেছি নম্রতার মাধ্যমেও কীভাবে নিজের দুঃখবোধ ও বেদনার কথা প্রকাশ করা যায়। অযথা বাহুল্য বিষয় নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা আমার নেই। মনসুর ভাইও ছিলেন সে রকম নিয়ম মেনে চলার মানুষ। সব সময় শিল্প-সাহিত্যের দীপ্তালোকে নিজেকে শরিক রাখার পক্ষপাতী। কারও সঙ্গে কোনো প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড একদম করা উচিত নয়। মনসুর ভাই আমার সেই সব কাজের নীতিবোধ সম্পর্কে কিছুটা জানতেন।

জীবনের শেষ দিকে আধ্যাত্মিকতার একটা অন্য রকম মরমি সুর মনসুর ভাইয়ের হৃদয়ে বাজত। তিনি আমাকে শেখ সাদি ও রুমি পড়ার কথা বলেছিলেন। তিনি বলতেন, বিশ্বাসের আলোকরশ্মির ছোঁয়ায় যে মানুষ চলতে পারে, তাকে উপহাস করা উচিত নয়।

পৃথিবীতে মানুষ মূলত পান্থপথের পথিক। পান্থশালা কখনো দীর্ঘ সময়ের স্থায়ী জায়গা নয়। মহাকবি রুমি বলেন, ‘পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক এ রকম, যেমন একজন পথিক গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিয়েছে; অচিরেই সে স্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে।’

পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক খুব ক্ষুদ্র সময়ের। এ জাগতিক জীবনের পর মহাজীবনের উদ্দেশে সবার প্রস্থান ঘটবে। মিছে মিছে এখানে বিহ্বলতার নিয়ত লোভে আত্মহারা হয়ে থাকা উচিত নয়। তবু শিল্প-সাহিত্যসহ সর্বক্ষেত্রে একটা লোভাতুর দৃষ্টি। অনেকের মধ্যে একই অঙ্গে নানান রূপ! সমাজে সেটি আগেও ছিল, আছে এবং থাকবে। তার ভেতর থেকেই আসলকে খুঁজে নিতে হয়। সাগরের তলদেশের মণি-মুক্তা আহরণের মতো আসল মানুষের স্বরূপ সন্ধান করতে হবে।

ডা. মনসুর আলীর মাঝে মাঝে সংক্ষুব্ধতা প্রকাশ পেত নিভৃতে নিঃসঙ্গতার অষ্টপ্রহরে। মানুষ নিয়ত নিঃসঙ্গ ও একাকী। তিনি প্রায়ই সে কথাটি বলতেন। মৃত্যু হচ্ছে মহাজীবনের মহাযাত্রা। মনসুর ভাই সেই যাত্রার অনুসঙ্গী হয়ে গেলেন। আমি ও আমরা একইভাবে সেই গন্তব্যের অভিযাত্রী। আমার কাছে ডা. মনসুর আলী অমর ও অনির্বাণ। কখনো তিনি বিস্মৃত হবার নন।

তবু কিছু মানুষের জন্য স্রষ্টার নিকট আমাদের প্রার্থনা থাকে। তিনি যেন স্বর্গত হন। শান্তিতে থাকেন। অনেকের মাঝে এমন আকুতি থাকে। যেমনটি কবিগুরুর ভাষায় :
‘যদি এ আমার হৃদয়-দুয়ার
বন্ধ রহে গো কভু
দ্বার ভেঙে তুমি এসো মোর প্রাণে,
ফিরিয়া যেয়ো না প্রভু।’

অতএব, প্রিয় মানুষদের টানে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে সর্বদাই যেন আমাদের হৃদয়-দুয়ার সব সময় খোলা থাকে। আল্লাহ পাক শ্রদ্ধেয় মনসুর ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। তাঁর পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Loading