– এবিএম সালেহ উদ্দীন
ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের সর্ববৃহৎ উৎসব। ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দ ও উৎসব। সমগ্র বিশ্বে প্রতিবছর দুটি ঈদ আসে। একটি ঈদুল ফিতর, অপরটি ঈদুল আজহা। দুটি ঈদেরই গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক। আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহাকে আমরা কোরবানির ঈদও বলে থাকি। সমগ্র পৃথিবীতে আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখ কোরবানির ঈদ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মহান আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানি তথা প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে পরিতৃপ্তির আনন্দে প্রতিবছর ঈদুল আজহা আগমন করে। সমগ্র বিশ্বের মুসলমানরা ত্যাগের মহিমায় উদ্বেলিত হন। গরিব-দুঃখী-অসহায় মানুষের মাঝে কোরবানির মাংস এবং প্রিয় সম্পদ বিলিয়ে দেওয়ার স্বর্গীয় আনন্দে মাতোয়ারা হন। ঈদের খুশিতে আনন্দবার্তা নিয়ে প্রতিবছর আমাদের মাঝে কোরবানির ঈদ আগমন করে।
ঈদুল আজহার সূত্রপাত মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) এর নিকট থেকে। কয়েক হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) এর আবির্ভাব ঘটেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন খুব মেধাবী। শিশুকাল থেকে তাঁর মাঝে তীক্ষè মেধা ও বিস্ময়কর চিন্তার উৎকর্ষ পরিলক্ষিত হয়। মানবিক বিবেকবানসম্পন্ন চৌকস বুদ্ধির অধিকারী একজন মনন চেতনার সৃজনশীল মানুষ। নিজের বুদ্ধি-বিবেক খাটিয়ে বিচার-বিবেচনা ছাড়া অন্ধের মতো কোনো অলীক বিষয়ের ওপর কখনো কোনো কিছুকে মেনে নিতেন না। ফলে শিশুকাল থেকেই তাঁকে নানা রকম পরীক্ষা ও মহাপরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মহান স্রষ্টা প্রদত্ত সেসব পরীক্ষা ছিল অত্যন্ত কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিটি পরীক্ষা তিনি কঠিন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে দিয়েছেন এবং বিস্ময়করভাবে উত্তীর্ণ হয়েছেন।
পবিত্র ঈদুল আজহা তথা কোরবানির ঈদটি মূলত সেই সব পরীক্ষার একটি চূড়ান্ত ফলাফল। এই ঈদকে ইসলামের ভাষায় সুন্নাতে ইবরাহিমও বলা হয়ে থাকে। মুসলমানদের প্রতিটি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) এর সন্তুষ্টি জড়িত। তেমনি পবিত্র ঈদুল আজহার সঙ্গে রয়েছে সমগ্র মুসলমানদের শত-সহস্র বছরের ইতিহাস, যে ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মুসলমানদের জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর পুত্র হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম। ইসলামের গোড়াপত্তনে আল্লাহ পাকের এই দুই মহান পয়গাম্বরের ছিল বিরাট ভূমিকা। মহান পিতা হজরত ইবরাহিমের পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) অনুসৃত নীতিবোধের মাধ্যমে (পিতার মতো) মহাপরীক্ষায় বিস্ময়করভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
কোরবানির অর্থ উৎসর্গ, অর্থাৎ প্রিয় বস্তুর উৎসর্গ। ধন-সম্পদ হচ্ছে মানুষের প্রিয়। সেই প্রিয় সম্পদের কিছু অংশ গরিব, দুঃখী, অসহায় মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিলে মহামহিম আল্লাহ খুশি হন। কোরবানির সূত্রপাত ঘটেছে হজরত ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) থেকে। কোরবানির ইতিহাস কমবেশি সবাই অবগত আছেন।
মহান আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গের বিষয়ে মহান দুই পয়গাম্বর (পিতা-পুত্র) মহা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর থেকে সমগ্র বিশ্বে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় ওয়াজিব। ইসলামের এই নির্দেশনা কোনোভাবেই অমান্য করা যায় না। শুধু তা-ই নয়, সেই থেকে হাজার হাজার বছর ধরে কোরবানি বা ত্যাগের বিষয়টি মানবীয় সংস্কৃতির একটি অন্যতম নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
প্রতিবছর কোরবানির ঈদ আমাদের সামনে এলে সেই সব আগেকার ঐতিহ্যময় ইতিহাস স্মৃতিদর্পণে উঠে আসে। হজরত ইবরাহিম (আ.) যখন প্রায় ৯০ বছরে উপনীত হন, তখন শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘদিনের বহুল কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত পুত্রটি তাঁদের কতটা আদরের হতে পারে; তা সহজেই অনুমেয়।
আগেই উল্লেখ করেছি, হজরত ইবরাহিম (আ.) সারা জীবন পরীক্ষা দিয়ে এসেছেন। তাঁর পরীক্ষাগুলো ছিল কঠিন থেকে কঠিনতর। অবিশ্বাস্যভাবে একেকটা একেক ধরনের। সেই শিশুকাল থেকে কঠিনতম সময়ের পরিস্থিতিতে সম্মুখীন হয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে পরীক্ষার পরম্পরায় চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েও তাঁকে উন্নীত হতে হবে। আল্লাহ পাক চান, প্রিয় পয়গাম্বর তাঁর কাছে আরও বেশি প্রিয়তর হয়ে ওঠেন। সেটি যেন পৃথিবীর তাবৎ মানুষের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে।
মহামহিম স্রষ্টা চান তাঁর পরমতম বান্দা-নবীকে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ করে নিতে। তিনি চান তাঁকে পবিত্রতার সর্বশীর্ষে স্থান দিতে। এবারের পরীক্ষাটি হচ্ছে আরও বেশি কঠিন ও ভয়াবহ। নিজের হৃদয়ের সর্বস্থানে যে আদরের ধন জুড়ে আছে, আল্লাহ চান সেখানে তাঁকে বসাতে। অর্থাৎ সর্বাগ্রে স্রষ্টাকে ভালোবাসতে। মূলত ইহাই কোরবানির আসল উদ্দেশ্য। তেমনি শিশুপুত্র ইসমাইলের মুখে কথা ফোটার পর পরম শ্রদ্ধেয় পিতার স্বপ্নের কথা বলার পর প্রত্যুত্তরে পুত্র ইসমাইল যে ধৈর্য ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, সেটি ছিল বিস্ময়কর। সেসব বর্ণনা পবিত্র কোরআনে আছে। তার পূর্বে এমন কঠিন পরীক্ষা ও ত্যাগের ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেনি।
স্বপ্নটি ছিল: পিতা ইবরাহিমের আদরের পুত্রধন ইসমাইলকে আল্লাহর পথে কোরবানি করার নির্দেশ। ইতিহাসে আছে, ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নটি দেখে কিছুটা বিব্রত হলেও বিচলিত হননি। তিনি সোজা প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরার (আ.) নিকট গেলেন এবং পুত্রকে সঙ্গে করে নিতে চাইলেন। আল্লাহর নির্দেশনার কথা শুনে তাঁয় স্ত্রী নির্দ্বিধায় পিতার হাতে কলিজার টুকরো ইসমাইলকে (আ.) তুলে দিলেন। যে শিশুকে নিয়ে হাজেরা (আ.) পাহাড়সম সংকটের মধ্য দিয়ে জনমানবহীন মরু প্রান্তরে কঠিন জীবনযাপন করেছেন এবং একটুও ধৈর্যচ্যুত হননি। আদরে সোহাগে সোনার টুকরো ইসমাইলকে বড় করে তুললেন। তাকে তার পূজনীয় পিতার হাতে তুলে দিতে কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত হননি। বিচলিত হননি।
হজরত ইবরাহিম (আ.) পুত্রকে নিয়ে কঠিন ও দুর্গম পর্বতমালা অতিক্রম করে মক্কার অদূরে মিনা উপত্যকায় এসে পৌঁছালেন। এখানেও যার চতুর্দিকে সুউচ্চ পর্বতমালা ঘিরে আছে। সেই জনমানবহীন পর্বতমালার পাদদেশে পিতা-পুত্রের মহামিলন একান্ত আলাপন। ইবরাহিম (আ.) শিশুপুত্র ইসমাইলের (আ.) নিকট মহামহিম স্রষ্টার ইচ্ছার (কোরবানি) কথা ব্যক্ত করলেন।
গা শিউরে ওঠার কথা! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.) সুদৃঢ় এবং একটুও বিচলিত হলেন না। বরং দৃঢ়চিত্তে অকপটে পিতার কাছে নিজের আত্মদানের বিষয়ে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির স্বার্থে অবশ্যই তিনি ধৈর্যশীলের পরিচয় দেবেন। পিতা ইবরাহিম (আ.) অবাক বিস্ময়ে পুত্রের কপালে চুমু দিয়ে স্বর্গীয় আদরের সিক্ততায় পুত্রধনকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। পরের ঘটনা সকলের জানা।
সেই থেকে ইবরাহিম (আ.) সুন্নাত হিসেবে মুসলমান মাত্রের ত্যাগ অথবা কোরবানির পথে এগিয়ে আসতে হয়। সামর্থ্যবান মুসলমানদের সে রকম পরীক্ষার শিক্ষা নিয়ে কোরবানি দিতে হয়। গরিব-দুঃখী, অসহায় মানুষের হক তাদের প্রদান করে মুখে হাসি ফোটাতে হয় এবং তাতে আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করো এবং পশু কোরবানি করো।’ (সুরা কাউসার-২) অতএব, কোরবানির সময় আমাদের সেই কাজটি অবশ্যই ঠিকমতো করতে হবে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের ঈদ সকল মানুষের জন্যই সমানভাবে আসে। ঈদের মহিমান্বিত আনন্দধারা সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য। এখানে ধনী-গরিব তারতম্য করা চলবে না। ঈদের অর্থই হলো সামাজিক আনন্দ ও খুশিকে সমানভাবে ভাগ করে নিতে হবে। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সম্পদে গরিবের হক আছে।’
আর পবিত্র কোরআনে আছে, বিত্তবানের অর্থ-সম্পদকে পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করার জন্য ইহা যেমন অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য, তেমনি প্রত্যেকের কাছে গরিব-দুঃখী, দারিদ্র্যপীড়িত অসহায় মানুষের অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা যাবে না। গরিব-দুঃখী, অসহায় মানুষকে ঠকানো এবং তাদেরকে অবজ্ঞা করা ইসলামে নিষিদ্ধ।
শুধু পশুর পশু হত্যা করে খেয়ে আনন্দ-ফুর্তিকেই কোরবানি বলে না। যে পশুটিকে নিদারুণভাবে জবাই করে ফুর্তি-উল্লাস করে ভক্ষণ করা হয়, তার অংশ অসহায়, গরিব-দুঃখীকে দেওয়া হয় না, এ ধরনের নির্লজ্জতার বিষয়কে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। তাই তো মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন :
“এয় ইব্রাহীম আজ কুরবানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন
ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’, শক্তির উদ্বোধন।”…
ঈদের দাবি হচ্ছে, সব মানুষকে নিয়ে আনন্দ উৎসব পালন করা। ঈদের খুশির ছোঁয়ায় সবাইকে শরিক করে তোলা। ঈদের দিনে একে অপরের ভালোবাসা ও মৈত্রীর বন্ধনে একীভূত হয়ে খাওয়াদাওয়া, গরিব-দুঃখীদের মাঝে দান-খয়রাতের মধ্য দিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইসলামের দৃষ্টিতে ত্যাগবিহীন ঈদের কোনো মূল্য নেই। যারা প্রচুর অর্থব্যয়ের মাধ্যমে শুধু নিজেরাই আনন্দ-উল্লাসে গা ভাসিয়ে দেয় কিন্তু গরিব-দুঃখী, অসহায়, বিত্তহীন, নিরন্ন মানুষের প্রতি খেয়াল রাখে না; এমন দুর্ভাগাদের ঈদ অর্থহীন এবং আল্লাহর কাছে ঈদের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ তাদের অপছন্দ করেন।
যারা ঈদের সত্যিকার আবেদন এবং ইসলামের মূল চেতনাকে বাদ দিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো শুধু উল্লাসে মত্ত থাকে, সে ধরনের জাহেলি ঈদের সঙ্গে ইসলামের ঈদের কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা ঈদের পুরো অনুষ্ঠানাদির সঙ্গে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির ব্যাপারটি একান্তভাবে জড়িত। এই বিষয়টির ওপর অবশ্যই সবার গুরুত্বশীল হওয়া উচিত।
ঈদুল আজহা হচ্ছে সমগ্র মুসলমানদের একটি ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উৎসব। সারা বিশ্বে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানির মাধ্যমে পৃথিবীর ধনী-দরিদ্র তথা সকল পর্যায়ের মানুষ ঈদের সত্যিকার রুহানি তৃপ্তি লাভ করেন। বিশ্বব্যাপী সকল মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ মৈত্রী সংস্থাপনের বিরাট সুযোগ তৈরি হয়। ঈদের মাধ্যমে মানুষের মাঝে শৃঙ্খলাবোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈদের আগমনে মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে। মানুষের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। ঈদের আহ্বান হচ্ছে, সকল প্রকার উৎকট-উচ্ছৃঙ্খলতার অবসান ঘটিয়ে একটি সুন্দর-সুশৃঙ্খলিত উন্নত জাতিতে পরিণত হওয়া এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্রতী হওয়া।
প্রতিবছর ঈদের আগমনে মানুষের মধ্যকার হিংসা-বিদ্বেষ দূরীভূত করে সাম্য-মৈত্রী ও সৌভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ উন্মোচিত হয়। কিন্তু আমাদের আজকের মানবসমাজ ঈদের প্রকৃত ইমেজ থেকে বঞ্চিত। তার প্রধান কারণ হচ্ছে মুসলমানরা তাদের আসল ঐতিহ্যের কথা ভুলে গেছে। হীন স্বার্থের টানাপোড়েনে আমরা নিজেদের মধ্যকার গ্লানিবোধকে জাগিয়ে তুলেছি। পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিসম্বাদকে বাড়িয়ে হিংস্রতায় পৌঁছে গেছে আজকের সমাজ। স্বার্থের জন্য ক্ষমতা আর ক্ষমতার জন্য বর্বরতা ও পাশবিকতায় ছেয়ে গেছে মানুষের এই সুন্দর পৃথিবী! মনুষ্যত্বহীন সমাজে ঈদের ইমেজ আসবে কী করে?
ঈদের প্রকৃত শিক্ষায় যেন সমগ্র জাহানের মুসলমানরা তাদের হারানো ঐতিহ্যের সঠিক আদর্শ ফিরে পেতে পারে, সে প্রত্যাশা আমাদের।
ঈদের প্রাক্কালে বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। করোনা ভাইরাসের ভয়ংকর মহামারি পৃথিবীকে নিশ্চল ও স্থবির করে দিয়েছিল। বিশ্বের মানুষ এক আতঙ্কময় বিপদের ঘনঘটা থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ রকম বিপদে নিপতিত হলে চরম ধৈর্য ও সাহস রাখতে হয়। মহামহিম স্রষ্টা মানুষকে ধৈর্যধারণ করার কথা বলেছেন। বিশ্বনবী (সা.) জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে বিপদের মধ্যে কঠিন ধৈর্যশীল ছিলেন। শত বিপদে তিনি ছিলেন সিসাঢালা প্রাচীরের মতো সুদৃঢ়। ধৈর্যের সুফল আছে।
ডেল কার্নেগি বলেছেন, ‘কোনো বিপদই চিরস্থায়ী নয়। একদিন মানুষ সূর্য ও মুক্তি দেখতে পায়।’ আর ফ্রান্সিস বেক বলেন, ‘বিপদকে সাধারণভাবে আনন্দ দিয়েই পরিশোধ করতে হয়।’ আসলেই ধৈর্য মানুষকে উন্নত করে আর মিথ্যা ও কাপুরুষতা মানুষকে ধ্বংস করে। অতএব, আমাদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে সবকিছু মোকাবিলা করতে হবে।
মুসলিম রাষ্ট্রসমূহসহ সমগ্র বিশ্বের মানুষ মহাবিপদ ও সংকটে আছে। ধৈর্যের মাধ্যমে তা মোকাবিলা করা উচিত। বিপদকে জয় করে নেওয়া এ মুহূর্তের অন্যতম কাজ। বিশ্বের মানববিধ্বংসী যুদ্ধবাজেরা থাকবেই। তাতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। করোনা নামক ভয়ংকর মহামারি এবং যুদ্ধবিগ্রহ ধ্বংসাত্মক বর্বরতার মধ্যেও মানুষকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এ অবস্থায় সমগ্র বিশ্বের মানুষের ঐক্যের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি অসহায় ও দুঃখী মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা আরও বেশি অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য।
এবারের ঈদ মুসলিম দুনিয়ার মাঝে সেই ঐক্য-সম্প্রীতির বন্ধন ফিরিয়ে আনুক, ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় হয়ে উঠুক। তেমনি দুঃখী মানুষের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার সুব্যবস্থার পাশাপাশি ক্ষুধাপীড়িত মানুষের ঘরে খাদ্য প্রদানের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। তাদের বিপদের সঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ানো উচিত।
আসলে বিপদ যতই আসুক, মানুষকেই তার মোকাবিলা করতে হয়। এটি মুসলমানদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কটি লাইন মনে পড়ছে :
‘যারা অশান্তি দুর্গতি চাহে, তারা তাই পাবে, দেখো রে ভাই,
উহারা চলুক উহাদের পথে, আমাদের পথে আমরা যাই।
ওরা চাহে রাক্ষসের রাজ্য, মোরা আল্লাহর রাজ্য চাই,
দ্বন্দ্ব-বিহীন আনন্দ-লীলা এই পৃথিবীতে হবে সদাই।’
কোরবানির বৈষয়িক ও সামাজিক উপকারিতাও অনেক। মুসলমানদের কোরবানির মাধ্যমে সমাজের ব্যবসায়ী মানুষদেরও সহযোগিতা করা হয়। তারা কোরবানির পশুকে অতি যত্নসহকারে বড় করে ভালো দামে বিক্রি করে নিজেরা যেমন লাভবান, তেমনি ক্রেতার মাঝেও পরিতৃপ্তি আসে। কোরবানির মাংস যেমন গরিব-দুঃখী মানুষ খেয়ে তৃপ্ত হয়, তেমনি কোরবানির চামড়ার অর্থ দ্বারা অসহায় মানুষ তৃপ্তি ও আনন্দের ছোঁয়া পায়। বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা অন্যতম আয়ের উৎস হচ্ছে কোরবানির চামড়া বিক্রির অর্থ উপার্জন এবং চামড়া ব্যবসায়ের আয়ের উৎস। অতএব, এই ঈদ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উন্নয়ন এবং সাম্য-মৈত্রী সুদৃঢ়করণের অন্যতম অবলম্বন।
পবিত্র ঈদুল আজহার ত্যাগ ও কোরবানি যেন আমাদের সবাইকে প্রভাবিত করে। আমরা যেন সকল সমস্যাগ্রস্ত মানুষ এবং বন্যাপীড়িত অসহায় মানুষের কাছে সাহায্যের হাত প্রসারিত করি। খুশির আনন্দে সবার মুখে হাসি ফুটুক। নেমে আসুক অনাবিল শান্তি। ঈদ আসুক সবার ঘরে। ঈদ আসুক সবার তরে। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।