আন্তর্জাতিক ফুটবলের ক্ষেত্রে ২০২২ সাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বছরের সেরা ইভেন্ট ছিল ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২। বিশ্বকাপের আগে আয়োজক দেশ কাতারকে নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে খারাপ আচরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে বিশ্বকাপের আগে আসা ফুটবলপ্রেমীদের জন্য দোহায় থাকার ব্যবস্থা করার জন্য অভিবাসী শ্রমিকদের কাতারের রাজধানী ছাড়তে বাধ্য করার খবর বারবার সামনে এসেছে। তবে, বাংলায় একটা কথা রয়েছে, ‘যার শেষ ভাল তার সব ভাল।’ কাতার বিশ্বকাপের ক্ষেত্রেও এই কথাটা বলা যায়। যে ভাবে কাতারে আয়োজিত হয়েছে এই বারের বিশ্বকাপ তা এক কথায় অসাধারণ। ফুটবলারদের জন্য়, অংশগ্রহণকারী দেশগুলির জন্য সুযোগ সুবিধা থেকে শুরু করে খেলা দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য নানাবিধ সুবিধা, ফ্যানজোনের আয়োজন এই বিশ্বকাপকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। ফ্যান জোনে পারফর্ম করেছেন খ্যাতনামা শিল্পীরা। বলিউড অভিনেত্রী নোরা ফতেহ-ও পারফর্ম করেছেন ফ্যান জোনে।
ভিড় ছিল কাতার বিশ্বকাপ
এ বারের বিশ্বকাপ অন্য মান পায় ছোট দলগুলি ভাল খেলায়। এই বারের বিশ্বকাপকে অনেক বেশি জমকালো করেছিল জাপানা, ঘানা, মরক্কোর মতো দেশগুলি। জাপান এই বিশ্বকাপে পরাজিত করে স্পেন এবং জার্মানিকে। এই দুই দলই অতীতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বিশ্বকাপে এবং ফুটবল সার্কিটের ঐতিহ্যশালী শক্তিধর দেশ। জার্মানিকে প্রথম ম্যাচে পরাজিত করেছেন জাপান এবং তারা হারায় ফ্রান্সকে। নক আউট পর্যন্ত যাওয়া জাপানের পারফরম্যান্স এশিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের কাতার মুখো কড়েছিল এই মহাদেশের বহু সমর্থককে। এ ছাড়া পর্তুগালের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার জয় বিশ্বকাপকে জমিয়ে দেয়। নক আউট পর্বও ছিল টান টান উত্তেজনায় মোড়া। সুইৎজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬-১ গোলে জেতা পর্তুগাল অপ্রত্যাশিত ভাবেব হেরে যায় মরক্কোর বিরুদ্ধে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোহীন পর্তুগালের প্রথম একাদশকে শুরু থেকে চেপে ধরে মরক্কো এবং যার ফলও পায় হাতেনাতে। অপ্রত্যাশিত তিনটি দলের বিদায় এই বিশ্বকাপকে অনেকের কাছে অঘটনের বিশ্বকাপে প্রমাণিত করে। স্পেন ,জার্মানি এবং পর্তুগালের ছিটকে যাওয়াটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। বিশেষ করে জার্মানির গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়াটা অপ্রত্যাশিত। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর এই বিশ্বকাপেও গ্রুপ পর্যায়ের বাধা টপকাতে পারেনি জার্মানি।
এ ছাড়া কাতার বিশ্বকাপ আরও বেশি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পায় লিওনেল মেসি এবং ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কারণে। বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের দুই সেরা তারকার শেষ বিশ্বকাপ ছিল এটি। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর সফল কোয়ার্টার ফাইনালে শেষ হয়ে গেলেও লিওনেল মেসি কার্যত একার দায়িত্বে পৌঁছে দেন আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে ফাইনাল ম্যাচও ছিল বিশ্বকাপের সর্বকালের সেরা ম্যাচ। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই রকম ফাইনাল হয়েছে কি না তা পরিসংখ্যানবীদের ঘেঁটে দেখতে হবে। কিলিয়ান এমবাপের হ্যাটট্রিক, মেসির জোড়া গোল এবং অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার একটি গোলে ১২০ মিনিটের খেলা শেষে ফল দাঁড়ায় ৩-৩। টাইব্রেকারে ফয়সলা হয় ম্যাচের। এমিলিয়ানো মার্টিনেজের বিশ্বস্ত হাত এবং আর্জেন্টিনার স্পট কিক নেওয়া ফুটবলারদের দক্ষতায় শেষ পর্যন্ত ৪-২ গোলে বিশ্বকাপ জিতে অধরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয় মেসির। ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা।
এই বছরই হয়েছিল ফাইনালেসিমা। কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টনা এবং ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিক মধ্যে আয়োজিত হয় এই ম্যাচ। ফাইনালেসিমায় ইতালিকে ৩-০ গোলে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনা। এই বছরই বিশ্ব ফুটবলে ঘটে আরও একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ইউরো কাপ জয়ী ইতালি ব্যর্থ হয় বিশ্বকাপের টিকিট অর্জ করতে। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ দলের শিরোপা নিয়েও ইতালিকে থাকতে হয়েছে বিশ্ব ফুটবলের সেরা টুর্নামেন্টের বাইরে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং লিওনেল মেসি ব্যালন ডি’ওর-কে নিজেদের দখলে রেখেছেন অধিকাংশ সময়ে। এর মধ্যে থেকেও এমন কিছু ফুটবলার রয়েছেন যাঁরা ফুটবল সার্কিটে ব্যক্তিগত পুরস্কারের শীর্ষ খেতাব অর্জন করেন। এই বছরই যেমন জেতেন করিম বেঞ্জিমা। এই বছর ফ্রান্সের বিশ্বকাপের দলেও ছিলেন বেঞ্জিমা কিন্তু প্রতিযোগীতা শুরুর আগে উরুতে চোট পেয়ে তিনি ছিটকে যান। শোনা যাচ্ছিল বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে করিম বেঞ্জিমাকে নামিয়ে চমক দিতে পারে ফ্রান্স কারণ তাঁর পরিবর্তে কোনও ফুটবলারকে নেওয়া হয়নি। কিন্তু ঘনিষ্ঠ মহলে বেঞ্জিমা জানিয়েছিলেন তিনি কোচের উপর হতাশার কারণে ফিট হয়ে যাওয়ার পরও আসেননি কাতারে। তিনি জানিয়েছিলেন ঘোনিষ্ঠ মহলে যে তাঁর চোট গুরুতর ছিল না, দুই-তিন সময় পেলেই ফিট হয়ে যেতেন কিন্তু কোচ তাঁকে ফিরে যেতে বলেন। ফ্রান্স বিশ্বকাপের ফাইনালে হারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন বেঞ্জিমা।
বিশ্বকাপে গোল্ডেন গ্লাভস জয়ী আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজের সেলিব্রেশন নিয়ে মুখ খুললেন এমবাপ্পে
বিশ্বকাপে গোল্ডেন গ্লাভস জয়ী আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক মার্টিনেজের সেলিব্রেশন নিয়ে মুখ খুললেন এমবাপ্পে ই বছরটা মনে রয়ে যাবে কিলিয়াম এমবাপের ঔদ্ধত্যের জন্যও। লাতিন আমেরিকার ফুটবলকে ছোট দেখিয়ে বড় দেখাতে তিনি চেয়েছিলেন ইউরোপীয় ফুটবলকে। এই বছরই আগে এমবাপে লাতিন আমেরিকার ফুটবলকে ছোট করেছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, খেলা মানের বিচারে ইউরোপীয় ফুটবল অনেক এগিয়ে লাতিন আমেরিকার থেকে এবং সেই কারণেই গত বার বিশ্বকাপ জেতে ইউরোপীয় দল। ঘুরিয়ে নিজেদের প্রশংসাই করতে চেয়েছিলেন তিনি। ব্যালন ডি’ওর-এর আগে তিনি জানিয়েছিলেন, মেসি-রোনাল্ডোদের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে। এ বার কোনও তরুণকে খুঁজে পেতে হবে বিশ্ব ফুটবলে। আসলে নিজেকেই বারবার প্রজোক্ট করার চেষ্টা করেন এমবাপে। বিশ্বকাপ জয়ের পর এমবাপেকে তাঁর ঔদ্ধত্যের আদর্শ জবাব দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ী গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। তিনি গোল্ডেন গ্লাভস জেতার নিজের সেলিব্রেশনের মধ্যে এমবাপেকে কটাক্ষ করেছিলেন। দেশে ফিরে একটি পুতুলে এমবাপের মুখোশ লাগিয়ে তিনি রোড শো-এর সময়ে সেলিব্রেট করেন যদিও এর কারণে তাঁর সমালোচনাও হয়।